কবি: আত্মার নিঃশব্দ ক্রন্দনধ্বনি - ফাল্গুনী ঘোষ

ফাল্গুনী ঘোষ
কবি: আত্মার নিঃশব্দ ক্রন্দনধ্বনি

প্রথম পর্ব 

বি হওয়ার জন্য কলমকে সচল রেখে নিজের চিন্তা ভাবনাগুলিকে বলে যাওয়াতে সংসার অগোছালো থাকে। যিনি আমার লেখা অতি সামান্য পড়েন অথবা পড়েন না তিনি বুঝবেন কি করে একটা লেখাকে দাঁড় করাতে গেলে ভেতরের মানুষটাকে কী প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়!চিন্তার যে পরিসর, পঠনের যে সময় তা অনেকটা সময়কে সাগরের সার্কের মত খেয়ে ফেলে। একটা সময়ে অনেকটা টাকা পয়সা ইনকাম করতাম যে পয়সায় হয়েছে অনেক কিছু। এখন আর ইনকামে মন নেই। লেখা আর পড়া। বই বিক্রির রয়্যালটিতে কতটুকু আর হয়! সেটা এ যুগে নগণ্য। যুগে যুগে লেখক ও কবির সাথে যেসব জীবনসঙ্গিনী ঘর করতে এসেছে তাদের অনেকের জীবন hell হয়ে গেছে। নারী, অধিকাংশ নারী চায় একটা সাজানো গোছানো পরিপাটি সংসার, well decorated, modern, furnished, গৃহসজ্জা, আসবাব,  এই সবইতো আধুনিক জীবনে বাঁচার অন্যতম স্ট্যাটাস ও অর্থময়তা। 

               সত্যি  সত্যিই তো তাই। বাইরে থেকে আসা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব বাড়ির ছিরি দেখলে কী ই বা বলবে! এ একরকম ব্যর্থতা।পৃথিবীতে কতিপয় মানুষ যারা সত্যিকারের লেখেন, যাঁরা লেখার জন্য সত্যি সত্যিই মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটার কে জাগ্রত রাখেন ,যারা সিরিয়াসলি লেখাকেই জীবনের ধ্রুবতারা করেন, তাঁরা জাগতিক জীবনের গৃহময় সাজসজ্জাকে প্রাধান্য দেবেন কখন! এ এক অনিচ্ছার অনীহা। পলে পলে অপমানের তীক্ষ্ণ শরাঘাত ভিতরের আত্মাকে ক্ষত বিক্ষত করে। আত্মার নিঃশব্দ ক্রন্দন কলমের কালিতে শব্দজাত হয়।এই লেখাটিও এক অব্যক্ত যন্ত্রণার উত্তপ্ত লাভা উদ্গীরণ। 

              সাংসারিক সুবোধ সুন্দর মানুষ কষ্টে সৃষ্টে বাড়ির আসবাব বানান। ঘর হয়ে ওঠে স্বপ্নপুরী, নন্দনকানন। কবির বাড়ি ছেঁড়াখোঁড়া অগোছালো। সত্যিই এই এক অপরাধ বোধ আমায় দিন দিন খ্যাপা কুকুরের মত তাড়া  করে।চুপ করে থাকি সময়ের ক্ষণিক অপমান ও  বিপর্যয়ে। কোনো মানুষ যদি আমাকে অপমান করে শান্তি লাভ করে থাকেন - তাই শ্রেয়। 

                আমার বাড়িতে হাজার পাঁচেক বই আছে। এই বইয়ের জ্বালায় অনেকেই অতিষ্ঠ। বইগুলো ঠিক ঠিক সংরক্ষণ করাটাও কষ্টের। বই রাখার জায়গাও ঠিকঠাক করে উঠতে পারিনি। এই নিয়ে শান্তিহীন স্রোত বয়ে যায় সংসারের নিকট আত্মীয়দের মনে। অথচ কোনো মানুষের কাছে বাড়িতে লাইব্রেরী আছে বলে pride নিতেও কার্পণ্য নেই। 

       একজন কবি বা সিরিয়াস লেখক কীভাবে একসঙ্গে জাগতিকভাবে একজন সাংসারিক ও দারুণ ভালো লেখক হয়ে ওঠেন, চিন্তক হয়ে ওঠেন আমার জানা নেই। তাই কবি ও লেখক হলেন ক্রুশকাঠে বাঁধা যীশু-- যার অদৃশ্য আত্মার কান্না শুধু সত্যিকারের বন্ধু লেখক পাঠক বুঝতে পারেন। জীবনানন্দের মত আমি অতটা অসাংসারিক নই।  আমি সংসারেই থাকি, কাজকর্মও করি, কিন্তু সংসারের নিকট আত্মীয়রা চায় অন্যকিছু ,তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী চলতেও পারিনা। এই অকর্মণ্যতা কবিকে ঘিরে ধরে সারমেয় বেষ্টনীর মত। অথচ কবির পুরষ্কার ও সম্মান প্রাপ্তিতে তাঁরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে গর্ব অনুভব করেন।

            গৃহী জাগতিক ঋদ্ধতা বিশিষ্ট সাংসারিক মানুষের বাড়িতে বই এর সেরকম বন্দোবস্ত নেই। সৌখিন স্বপ্নের মন্জিলে তাঁদের নিত্য অবগাহন।কিন্তু বই হল একটা ঘরের আত্মা। বই ছাড়া একটি ঘর যতই সৌন্দর্যসুশোভিত হোক আসলে অন্ধকার। প্রদীপহীন একটি ঘর আঁধারের সমতুল্য।আমি দেখেছি এমনি এমনি কত কত সুন্দর বাড়িতে গৃহসজ্জার অঙ্গ হিসাবে রবীন্দ্র শরৎ রচনাবলী শোভা পেতে থাকে কাঁচের ঝকঝকে আলমারিতে। 

             বাংলা সাহিত্যের কিছু কবির বিষয় ব্যাপার আমি জানি,জাগতিক - অজাগতিক এইসব সম্পর্কে। কবি গণেশ বসু একজন চিন্তক কবি। বেশ ঋদ্ধ কবিতা লিখেছেন। বাংলা সাহিত্য পড়িয়েছেন দীর্ঘদিন কলেজে। অসম্ভব দারিদ্র যাপন করে উদ্বাস্তু সন্তান গণেশ বসু হিসেবী জীবন যাপন করেছেন। ছেলে মেয়েগুলিকে জীবনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কোলকাতা শহরের অভিজাত এলাকায় তিনতলা সুন্দর বাড়ি করেছেন। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কবিদের থেকে কবিতার পাঠক বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থেকেছেন। তিনি জাগতিকভাবে খুব সফল এবং কবি হিসাবে সমৃদ্ধ। কিন্তু তাঁর যাপনে কবিত্ব কম।এখন তাঁর নাম বললে কতিপেয় শহুরে পুরোনো কিছু কবি ছাড়া কেউ চিনে উঠতে পারেন না। 

                     
             দ্বিতীয়  পর্ব 
             

            কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় সারাটা জীবন কবিতা নিয়ে যাপন করে গেলেও জাগতিক জীবনে সাংসারিকভাবে ব্যর্থ মানুষ।তাঁর একমাত্র কন্যা সুপাত্রস্থ হতে পারল না। ভাঙা ঘরেতে বাহান্ন বছর আমৃত্যু কাটিয়ে গেলেন। যদিও একটা ছোটো ছিমছাম ফ্ল্যাট কিনেছিলেন শেষ জীবনে।কবি গণেশ ও কবি পবিত্র হলেন খুব খুব সমসাময়িক এবং একে অপরের বন্ধু। কবি পবিত্র এখন প্রবাদ প্রতিম। তেষট্টি বছর ধরে করে চলা তাঁর 'কবিপত্র' পত্রিকা বাংলা কবিতার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র। কবি পবিত্র মহাকবিতার জনক। এবং অসম্ভব ভালো সনেট রচয়িতা।কবি পবিত্র সংসার ও জাগতিক মানুষ হিসাবে ব্যর্থ প্রাণ সেকথা আমাকে বারবার বলতেন। তাঁর আত্মার ক্রন্দনধ্বনি

আমরা শুনি বেজে ওঠা তাঁর কবিতায় :

" প্রকৃত কবিতা থাকে মানুষের বঞ্চনার উৎস ও শিকড়ে ;
কবচ তাবিজ নয়,বেদনার সঙ্গী হয়ে বুকে নেয় শীতল উত্তাপ,
প্রকৃত কবিতা কাঁধে হাত রাখে প্রিয় সখা, নারী মণ্বন্তরে 
যুদ্ধ ও সংশয়ে দুঃখ ভাগ করে নেয় পূণ্য পাপ;"

                 আধ্যাত্মিকভাবে অসংবেদনশীল মানুষ মননশীলতায় পিছিয়ে। যেসব মানুষ জাগতিক লাভ ক্ষতির অবিরাম নিরীখে জীবনটাকে মাপতে বসে তারা লেখকের হৃদয়ের কান্না ও যন্ত্রণার মর্মভেদী উচ্চারণকে সংবেদী চোখে দেখবে কি করে? সেই সংবেদ তো তাদের তৈরী হয় নি। মানুষের আত্মার প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ তার প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির অধীন। যদিও সে তার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সংবেদি হতে পারে। নিজেকে তৈরী করা - না, লাভ ক্ষতির জাগতিক পাটিগণিতে নয়। আত্মিক জ্ঞানের উদ্ভাসী আলোয় ধীরে ধীরে সময়ের প্রগতিতে নিজেকে ভাঙতে হয় সেল্ফ স্টাডির মধ্য দিয়ে। মহাকবি মিলটন তাইতো বললেন:

"What in me is dark, illumine;"

এই রাবীন্দ্রিক বচন: "অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, 
সেইতো আমার ভালো "।

উপনিষদের বাণীকে পাথেয় করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে যদি জীবনে সত্যিকারের শান্তি ও bliss পেতে হয়। - "তমসা মা জ্যোতির্গময় " - এই তমসা অর্থাৎ অন্ধকার ,মানুষের ভোগের অন্ধকার। materially আপনি খুব সুখী কিন্তু spiritually সুখী নন। মানুষের 'spiritual' সত্তা আছে। পশুর নেই। মানুষ আর পশুর তফাৎটাই এখানে। মহান গ্রীক সক্রেটিস বললেন " সুখী পশু হওয়ার চেয়ে অসুখী মানুষ হওয়া অনেক ভালো "। অসুখী মানুষ বলতে এখানে সংবেদি মানুষের কথা বলা হয়েছে। 

               মানুষ তো আজ টাকার বিনিময়ে সব কিছুর সাফল্য ও ব্যর্থতা বুঝতে শিখেছে। এই টাকার যেমন দরকার ঠিক তেমনই টাকার বিনিময়  মূল্যের উপরে অবস্থান মানুষের আত্মিক মূল্য,সেটি সাধারণ জাগতিক মানুষের চেতনার বাইরে। অনেক সময় অনেক মানুষকে বলতে শুনি যে কবিরা স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। কবিকে লেখার জন্য অনেক সময় কম বন্ধুবৎসল হতে হয়, তাঁকে লেখার সময় ও রসদ বার করে নিতে হয়। কবিতো পৃথিবীর মানুষের কথাই বলেন। নিপীড়িত, অবহেলিত, অত্যাচারিত মানুষের কথা কবির কলমে ধ্বনিত হতে দেখি। কবি কি শুধু নিজের কথা, নিজের সংসারের কথা ভাবেন নাকি! তিনি বিশ্বচরাচরের ঘটমানতার খবর রাখেন। একটি শরণার্থী শিবিরের শিশুর জন্য কবি কবিতা লেখেন। শীতে জমে যাওয়া উদ্বাস্তু শিবিরের কান্নাঝরা মায়ের কথা উচ্চারণ করেন কবিই। তাহলে কবি কি করে স্বার্থপর! তিনি তাঁর লেখার টেবিলে 'স্বার্থপর', একাকী, নিঃসঙ্গ। আমরা পৃথিবীর বড় বড় কবিদের দেশে ও বিদেশে দেখেছি তারা কিভাবে যুগে যুগে প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছেন।

                      কবিতার জগৎ দুই রকম চেতনার অভিঘাতে স্পন্দিত। একটি হ'লো শিল্পের জন্য শিল্প - অর্থাৎ হল 'কবিতার জন্য কবিতা', অন্যটি হ'লো জীবনের জন্য কবিতা - বা 'জীবনের জন্য শিল্প'।শুধুমাত্র আত্মিক মানুষ ফুল, পাখি, গাছ, নদী, মেঘ, সাগর, সূর্য, চাঁদ নিয়ে নান্দনিক কবিতা লিখলে তা হয়ে ওঠে কবিতার জন্য কবিতা। একে আবার বিশুদ্ধ কবিতাও বলা হয়ে থাকে। যেমন আলোক সরকারের কবিতা। আর জীবনের বহুমাত্রিক সংবেদ, সন্ত্রাস ও দ্বেষ, প্রতিবাদ ও প্রতিস্রোত, সমাজমনস্কতা ও পৃথিবীর মানুষের অভাব, অভিযোগ , হাহাকার যে কবিতায় আবর্তিত হয় তাকে আমরা বলতে পারি - "art for life's sake" অর্থাৎ 'জীবন বোধের কবিতা'। পৃথিবীর সব বড় কবি-ই জীবনের জন্য মানুষের জন্য লিখে গেছেন। 

                      সুতরাং কবি-আত্মার নিঃশব্দ ক্রন্দনধ্বনি শুনতে গেলে মননের ঋদ্ধতা দরকার। লেখকের যন্ত্রণা বুঝতে পারেন সুপাঠক। ধূপের পুড়ে যাওয়ার যে যন্ত্রণা সে যন্ত্রণা লেখকের। সুগন্ধ পান করে পাঠক। অথচ পাঠক যদি লেখককে বুঝতেন তাহলে পাঠকের জীবনে একটা সৃষ্টিশীল বোধের অর্থ তৈরী হতে পারে। কবি যন্ত্রণা-মুখর , অদৃশ্য তার রক্তক্ষরণ নিঃসঙ্গ নিলয়ে নেমে আসে অনিকেত অলিন্দ থেকে চুঁইয়ে পড়ে উদগ্রীব ভাষা, লিখিত হতে থাকে স্বরলিপি। 




Author Photo

ফাল্গুনী ঘোষ

ফাল্গুনী ঘোষ একজন বিখ্যাত কবি এবং লেখক, তার চিন্তা-উদ্দীপক এবং আবেগপ্রবণ কাজের জন্য বিখ্যাত। মানুষের অবস্থা অন্বেষণের জন্য একটি আবেগ সহ, তার লেখা এর গীতিকারত্ব, গভীরতা এবং সূক্ষ্মতার জন্য প্রশংসিত হয়েছে। তার কবিতা এবং গদ্যের মাধ্যমে, ফাল্গুনী ঘোষ বিশ্বব্যাপী পাঠকদের অনুপ্রাণিত ও মুগ্ধ করে চলেছেন।

Post a Comment

যোগাযোগ ফর্ম