গুচ্ছ কবিতা - সেলিম মন্ডল

সেলিম মন্ডল
ধোঁয়া
 

তুমি কি সেই হাঁসফুলের মালা
যার তরঙ্গে ভেঙে যায় পালকের ঢেউ?

বিকাল আসে জবা ফুলের মালা নিয়ে... 
ঘরে ফেরা হাঁস—

সূর্যাস্তে রামধনু কাটে

দূরের উনুনে যেন জেগে ওঠে তারই সুস্বাদু ধোঁয়া!

 

জোৎস্না

জ্যোৎস্নায় ডুবে যারা মারা গেল, তাদের দেহ পাওয়া যায়নি
বৃষ্টি নেই, অথই জল...

কে কে মারা গেল নিখোঁজের খোঁজে তা রটে গেল

শোনা গেল, এরই মধ্যে চাঁদ উঠছে, আবার চাঁদ উঠেছে...

 

পিতৃসমান

ছোট ছোট স্বপ্ন আঁকছি
ভাঙা রং-পেনসিলে ট্যারাব্যাঁকা দাগ...
লাল-নীল-সবুজ-হলুদ... যেন রামধনু নেমে এসেছে স্বপ্নের গা'য়
নতুন শিশু খেলবে... টলমল পায়ে... আকাশের এই ভালোবাসা পিতৃসমান

 

একা

আপনার দুঃখে আপনি কাঁদেন কিনা, সেটা মুখ্য বিষয় নয়।
মুখ্য বিষয় হল— আপনি দুঃখে একা হন কিনা।
এখন আপনি বুঝতে পারছেন না— দুঃখে আছেন, না আনন্দে।
দিব্যি খিদে পাচ্ছে। হাসি পাচ্ছে। চোখ দিয়ে টপটপ 
জল ঝরছে...

এই মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে চাইছেন... পারছেন না...

কেউ ভাবাচ্ছে।
মেঘেঢাকা পাহাড়ের মতো ভাবাচ্ছে। 
রোদবৃষ্টির কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

থিতিয়ে পড়া ব্ল্যাক চায়ের মতো তখন আপনি, একা

ধোঁয়া উড়ছে।
আরও মেঘ জমছে পাহাড়ে।
রোদবৃষ্টির কিচ্ছু কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

 

মাফলার

কখনো কখনো অদ্ভুত মনখারাপ জাঁকিয়ে বসে। মনে হয়, মনখারাপের শীত এসেছে।
তাকে কাঁথা-কম্বল দিতে হবে। পা ধোঁয়ার গরম জল দিতে হবে। নলেন গুড়ের ভাপা পিঠে খাওয়াতে
হবে। দরিদ্র মানুষের ধনী শীতকাল থাকে না। মাঠজুড়ে পড়ে থাকা কাটা ধানের মতো নত হলুদ
মুখে টাটা জানিয়ে বিদায় জানাতে হয়। সেও তো বন্ধু... কিছুতেই ছাড়তে চায় না। আমার ছেঁড়া
মাফলারের ভিতর ঢুকে পড়ে। আমার মাথায় বিলি কাটে। আমি ধনী শীতের বন্ধু হই। আমি মনখারাপকে
একটা মাফলার দিয়ে ভুলিয়ে রাখি।

 

ইলিশ

বাংলাদেশিরা সম্বৎসর হা-হুতাশ করেন— তাদের সব ইলিশ খেয়ে নিল ইন্ডিয়া
আর পদ্মার ইলিশ আসবে বলে গোটা বর্ষাকাল জুড়ে অপেক্ষা করতে করতে ভারতবাসীরা
ছিঁড়ে ফেলেন পায়ের সুতো
বাজারে রোজ একবার করে খোঁজ করেন— পদ্মার ইলিশ কি ঢুকল?
খুব শীঘ্রই আসবে... ডায়মন্ডের ইলিশ, দীঘার ইলিশ দেখিয়ে তাঁদের আশ্বস্ত
করেন—
ভালো সাইজ নিয়ে যান, আজ খেয়ে কাল এসে দাম দেবেন...
খোঁজ নিতে আসা মানুষটি দেখেন— পদ্মার ইলিশ তো দূর... পকেটে ডায়মন্ড
বা দীঘার ইলিশ কেনার মতো টাকা নেই
কোনায় বসে থাকা, খোকা ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন... ফিরে গিন্নিকে বলেন—
সরষে বাঁটা দিয়ে রান্না কোরো... ছেলেমেয়ে অনেকদিন ধরে ইলিশ খেতে
চাইছে

 

আমাদের ভালোবাসায়

আমাদের ভালোবাসায় একট গাছ বেড়ে ওঠে 
অজান্তেই আমরা সেই গাছে জল দিই
ওই গাছ ফুল দেবে বা ফল দেবে তা জানি না
গাছ বড়ো হলে বাতাস দেবে... এইটুকু জানি, আর জানি বলেই— পাতা ঝরার
আওয়াজে
ভেঙে ফেলি ঘর!

আমাদের ভালোবাসায় কী নেই আর কী আছে
এই খোঁজাখুঁজির পর্বে দু-জনে যেখানে হারিয়ে যায়
সেখানে দেখি, একটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে, কী বিশাল তার ছায়া।

একদিন সব ক্লান্তি মুছিয়ে দেবে মাথা
এত জল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে, মনে হবে একটা সমুদ্র
আর বেড়াতে এসেছি সেখানে
ছোটো ঢেউ, বড়ো ঢেউ আমাদের ফেলে এসেছে
আমরা মাছের মতো দুই প্রাণী শুধু অবশিষ্ট আছি

তুমি অপেক্ষা শিখে গেলে জানবে তুমিই একমাত্র পাখি
কোথাও দানা থাকুক বা না-থাকুক তুমি ঠিকই ওড়ার আকাশ পাবে

একটা আকাশ, নিজস্ব আকাশ!

 

জাদুকর

একদিন জাদুকর হয়ে যাব
কালো রুমালের দিকে তাকিয়ে দেখবে
তালু থেকে তুমিই উড়ে যাচ্ছ... সাদা পায়রা হয়ে

সমস্ত সাদা কাগজ চিবিয়ে ফেলব
তারপর জল খাব
এরপর মুখ থেকে এত লাল-নীল-সবুজ কাগজ বেরোবে 
মনে হবে উৎসব

পেটে ছুরি ঢোকানো হচ্ছে
বেরোচ্ছে রক্তও
মানুষটি মরছে না... এমনই ছুরি নিয়ে 
সবাই যে যার মতো পেরিয়ে যাচ্ছে জন্মদিন

নিমেষেই উধাও হয়ে গেল কয়েন
হাতের তালু এমনই এক আশ্চর্য জায়গা
যে গরম করতে পেরেছে সে অনেকটা আদরে
বানিয়ে ফেলেছে বাগান

‘গিলি গিলি ছুঃ' বলতেই খুলিটি নড়ে উঠল

কেঁপে উঠল মঞ্চ, জ্বলে উঠল আরও আলো

হাততালি আর হাততালি..

কোথাও দূরে পুড়ছে নিথর দেহ

তার গন্ধ কারো নাকে পৌঁছাচ্ছে না
একমাত্র জাদুকর... খেলার পর ফিরবে... তাকে দেবে অশ্রুপাত





Author Photo

সেলিম মন্ডল

সেলিম মণ্ডল থাকেন নদিয়ার চাপড়া। ‘তবুও প্রয়াস’ পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি কবিতা, গদ্য, গল্প লিখে থাকেন। এযাবৎ তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ— ‘মায়াজন্ম’, ‘লবণ খেতের জোনাকি’ ও ‘কাঁচা মাংসের বাড়ি’ এবং একটি গদ্যগ্রন্থ 'নীল কুয়াশার জোছনা' প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে একটি ভিন্নধর্মী টেক্সট 'এই পথ পরিকল্পিত' নামে গ্রন্থ এবং একটি সম্পাদিত গ্রন্থ— ‘ছাদ পেটানোর গান’।

Post a Comment

যোগাযোগ ফর্ম