মুক্তগদ্য: পাতা খসানোর গল্প - শমীক জয় সেনগুপ্ত

শমীক জয় সেনগুপ্ত
পাতা খসানোর গল্প

অন্ধকার ঘর। শরীর বলতে ওই একরত্তি আমি। আর পাশে থাকা পাশবালিশ ভেজা, বীর্যে স্ব-মেহনের ফল বা স্বপ্নদোষে নয়। কান্নাকাটি করিনি, তাই চোখের জলেও ভেজেনি বালিশ। খালি জ্বর ছাড়ার মতো আমার কানের লতি, নাকের পাশের বর্ডারলাইন, বুক ও পেটের মাঝামাঝি যে কাঁটাতার সবই ঘামে সপসপে হয়ে গেছে। আসলে শরীরটা বেশ নাকাল হয়েছে। ছেলেবেলায় বি.আর চোপড়ার মহাভারত আর বিশেষ করে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সিন আমাকে বেশ ভাবতে সাহায্য করতো আমি যাজ্ঞসেনী। একটা গামছাকে বুকের ওপর জড়িয়ে আমি আধো বোলে দো-পদী সাজতাম। তবে সাজ তো সাজই। খসে যায় বসন্তের পাতা। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল কৃষ্ণ। না ছায়া পড়া জলে কোন বিপ্রলব্ধা মেঘ বলেনি – “ বৃকোদর বা ধর্মসুত নয়, নয় নয় সুন্দর নকুল বা প্রাজ্ঞ সহদেব। হে ফাল্গুণী আমি তোমার জন্য আভরণ করি। পূর্ণ করো আমাকে”। কিন্তু এ মেঘও জলধর। ওই বাঁশী বাজাতো দ্বাপরে। এ যুগে সে বেশ মসিময় হয়ে ওঠে বৃষ্টি নামাবার জন্য। আরশীতে ছায়া পড়ে, পুরুষের ছায়া। এ ছায়া আমার নিজের। 

আমি কেউ নই, এই বোধটা যখন বেড়ে ওঠে তখন চক্ষুষ্মান হয়ে ওঠে আমার অস্তিত্ব। গোষ্ঠপাড়ার বোষ্টমী গেয়ে ওঠে – “ বনমালী পর জনমে হইয়ো রাধা”। সংসারকে বলা হয়নি, "আমি বনমালী, রাই হতে চাই না ..." । তবে যা চাই তা যাচাই নয় বলেই বোধহয় শরীরে কিরকম স্বেদবিন্দু। আমার পুরুষগুলো আমাকে বিছানায় কিভাবে দেখবে সেটা কখন যেন সবার চোখের সামনে ছাপিয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু কেন? আমার চোখে আমি কে সেটা কি বেশী জরুরী নয়! বোষ্টমীর একতারা বাজছে আর হৃদতন্ত্রী বলছে “চিরদিন আপনি (মাধব) মন্দিরে মোর”। প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে খেতে সবজান্তা শমীকের কলমে এল। তার মনে শীত। স্পর্শ সব হিম। সেই কোন আর্যকালে এক ছিঁচকে চোর তার মন ভেঙেছিল বলে সে স্বেচ্ছায় খুলে ফেলেছিল রক্তকরবীর মালা। বাতাসে মাধবী আর ছাতিমের গন্ধ যতই ম-ম করুক, রুক্ষ মনে কাঁটাঝোপ আর আলকুশী ছাড়া দু এক গাছা দুব্বাও জোটেনি। এমন কি জন্মকালীন পারিজাতের সুগন্ধও সে লুকিয়ে ফেলেছিল বিষাদে। তবু কাছে এলে যারা সুবাস পায় তারা জানে পুরোটা কৃত্রিম নয়। 

পার্ক অ্যাভিনিউর সঙ্গে কস্তুরীর ঘ্রাণ মিলে মিশে স্বপ্ন স্বপ্ন গন্ধ ছড়ায়। সে স্বপ্নের ঋতু বদলায় কিন্তু সে নিজে ঋতুমন্ত নয়। নাকি ঋতুও নির্বাসিত!
ভাবতে ভাবতে পুজো আসে। কাঁচ ভাঙা আয়নায় মুখ দেখতে নেই। কিন্তু ত্রস্ত তার পা নিজেকে দেখেছিল আয়নায়। আর ভাঙা কাঁচের আদরে  হিম শীতল নীহারের ওপর ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ … সে আভা দেখে সূর্য বলে, "গ্লানি ভুলে যাও"। 

কিন্তু মন শুভ হলেই জীবনে সব কি ভাল হয়, না হতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে রাত ঝাপসা হয়। কারা যেন বলে ওই রাস্তায় একদল ফুল হেঁটে যাবে। তাদের নানা রঙ, নানা গন্ধ। 

শরীর মনকে জিজ্ঞেস করে – জেগে আছ! 

মন আমার ভিতর দিয়ে বলে – এই তো।

আচ্ছা আমার তবে কি রঙ হবে বল? জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে সে দেখে তার গায়ে এখন কোথাও লাল, কোথাও কমলা আবার কোথাও নীল- বেগুনী বা সবুজ। হলুদ অতসীর সঙ্গে আসমানি হালকা আভাও আছে সেখানে। নিজেকে এত রঙে দেখে আমার কেমন অন্যরকম মনে হল।

এমন সময় বাইরে থেকে কারা যেন বলল – এবার তো এসো। পাতা তো খসাও। বসন্ত তো এসেই গেছে। এবার তো মাথা তুলে হাঁটো।



Author Photo

শমীক জয় সেনগুপ্ত

জন্ম: ৯ই অক্টোবর ১৯৮৬, কলকাতায়। প্রকাশিত বই 'নদীর কাছে ওরা ক'জন', 'পকেট ফুল অফ জয়', 'অক্ষরবীজ সমীপেষু' প্রভূতি। পুরস্কার: কচি কাঁচা শিশু সাহিত্য সম্মান (১৯৯৬), সরলাবালা স্মৃতি সম্মান (শিশু সাহিত্য) [১৯৯৯], চূণী কোটাল সম্মান (২০১৭), ও সাগর বিশ্বাস স্মৃতি সম্মান (২০২৩)।

Post a Comment

যোগাযোগ ফর্ম