অনুপম মন্ডল
নিঃসঙ্গ কেতকীর মতো
*
ঝোপ ঝাড়ে জোনাকির বান ডাকিয়াছে। কামিনী গাছটার ডালপাতায় এতোটুকু নিবিড় অন্ধকার । থেকে থেকে ঘুরঘুরে পোকাটা কাকে যেন ডাকে। কোথাও ঝিলের জলে একটি দুটি তারার সোনালী আলো ওই নিবে এলো। কেউ নেই। কেউ নেই আর কোথাও। পুকুর পাড়ের ঝুরিনামা বটগাছটার পাতাগুলো হাওয়ায় মর্মর শব্দ তুলে শুধু কাঁপছে।
*
জোনাকির ভার নিয়ে নুয়ে আছে নিসিন্দা গাছ। রাই জাগো, শ্যাম জাগো—ডাক দিয়ে হেঁটে চলেছে বোস্টম। এখনও ভোর হতে কিছুটা দেরী। লটকন গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, আকাশের কোল বেয়ে শিমুল তুলোর মতো কতো কতো অলস মেঘের দল, ছায়া ফেলে ওই উড়ে যায়। আমাদের ছোট্ট উঠোনখানি ডুবে থাকে, লেবু ফুলের গন্ধে। আর লেবু ফুলের গন্ধে।
*
সেইসব পুরাতন দিনের কথাগুলি মনে পড়ে! কোথাও ঝুঁকে পড়া, ছেঁড়াখোঁড়া ছায়াদের ছোপ। শিশিরের জল ঝরে ওই টুপুর-টুপুর! দিদি নেই। কতো দিন হয় দিদি বাড়ি নেই। সেই কুঁচবরণ রাজকন্যার মায়াবী গল্পের মতো একেকটা বিষণ্ণ দুপুর, শুধু, চাঁপাগাছটার ডালে ডালে তেলকুচা লতাটিরে আঁকড়ে ধরে কাঁচপোকাটা দুলছে আর দুলছে।
*
আরতির কাঁসর ঘণ্টা থেমে গিয়েছে সেই কখন। হয়তো, কিছু পরেই মা ফিরবে। বউঝিদের ধান পিটানোর ঝুরঝুর শব্দ, এখন নিঝুম হয়েছে। জানালার পাশে হলদে ফড়িঙের ফিনফিনে ডানার শব্দ এইবার নিবে এলো! আমি চেয়ে দেখি দূরে, আকাশ পারের ওই সন্ধ্যাতারা। বনশিমুলের এলোমেলো মাথা নুয়ে আসে। একটি দুটি পাতা, ওই, কোথায় উড়ে যায়।
*
কে যেন বিষাদের কথাটুকু ফেলে গেছে শুধু। কলকে ফুলের গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে, অঞ্জলি পিসির চিনিয়ে দেয়া সন্ধ্যা তারাটিকে আজ আবার কতো দিন পর দেখা। ওই তো কুমড়োর মাচা, শিয়ালকাঁটার ঝাড়। শিশিরের জলে স্নান সেরে নিচ্ছে। দূরের আকাশ পাড়ে যে চাঁদ উঠেছে, বন ডুমুরের বড়ো পাতার ফাঁক গলে তার এতোটুকু আলো এসে পড়েছে গোলা ঘরের সামনে। আমাদের রাধাগোবিন্দ মন্দির, আলোয় আলোয় ভিজে যাচ্ছে।
*
হয়তো কেউ ডাক দেয় দূরের থেকে। কিছু আগে, সাঁজাল জ্বেলে দিয়ে ফিরে গেছে ন’কাকিমা। কাঠবাদাম গাছের লালচে পাতার ফাঁকে বকফুলের মতো কাঁপছে, ওই নিশীথ মেঘ। সবাই কি ফিরে আসে! কিছুটা আঁধার করে এসেছে নেমে! জোনাকিরা, যেইখানে গান ফেলে গেছে!