শীর্ষা
কথা অনঘসমান
১
কাব্যিরসে দিব্যি আছি— "শোন বাছা, শোন"
শিশুপুত্র জন্মক্ষণে দিব্য যে লগন
করেছে মায়ের প্রাণ আকুলি-বিকুলি,
নাওয়া-খাওয়া নিত্য কর্মটুকু ভুলি
দিবানিশি নেচে মরে পরান আমার,
পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা সঙ্গ তোমার
"আহা, উহু" শোরগোলে বসায় বাসর
মুগ্ধ করে ক্ষুদ্র দেহে; তুমুল কাঁসর
শব্দযোগে পূজা সারে, ভরে ওঠে গেহ,
স্তনপানে দেবশিশু করে ধন্য দেহ—
কেঁপে ওঠে আত্মা মোর, কাঁপে যে শরীর,
মাতা-পুত্র একদেহ পুণ্যজল স্থির!
আজি সেই কাব্যিকথা শোনে মুনিবান।
কাব্যিরসে ভাসে হৃদি অনঘসমান।।
২
ধন্য হোক পুত্র মোর, ধন্য আমি মাতা
ধন্য যত জীবকুল, কুলের দেবতা!
এ ধরণী ধন্য হল যোনিদেহ ধরে
প্রাণের মৃত্তিকা ফাটে প্রাণের শিকড়ে।
মায়াবৃষ্টি ঢালে প্রাণ, দীর্ঘ কামনায়
মাতা ডাকে নেচে ওঠে দৈবের কৃপায়।
স্ত্রীদেহ পরমদেহ ঈশ্বরীসমান!
গর্ভজুড়ে প্রাণসখা আত্মিক সোপান—
এইরূপে যত নারী দৈবশক্তি পায়
অভয়া বরদারূপী, নরের সহায়।
মুনি যবে বলে কথা চোখে আসে জল,
ঋণ তার আঁখিপাতে দীঘি টলমল!
আজ তবে এই কথা শোনো মুনিবান।
ধন্য মাতৃ ধন্য কথা অনঘসমান।।
৩
কী-বা পুং? কী-বা স্ত্রী? অর্ধনারীশ্বর!
কাঁধেতে রেখেছ সতী, চোখে যে প্রখর।
রুদ্ররূপ সাধু তুমি পিতামাতাহীন,
তোমাযোগে আমাগর্ভে বাঁধা থাকে ঋণ।
বেঁধেছ ঘুঙুর পায়, গায়ে বাঘছাল;
তোমা পদে এই মা— তোমারই কাঙাল!
ভস্মমাখা ক্লেদহীন একান্ত নির্মল
রূপ দেখে বক্ষ ফাটে, চোখে আসে জল।
এমন আধার যেন অরূপবাহার—
পদতলে মাথা নমি, কী আছে করার।
তুমি পুত্র শৈবযোগ, দৈবের নিদান
মন্দিরেতে ঠুকে শির, প্রাপ্তির বিধান
মেনে চলে মাতা আজ— বলে মুনিবান।
শিব যেথা সর্বরূপী অনঘসমান।।
৪
দুগ্ধ ঝরে দুগ্ধ ঝরে, টপটপ সুর!
দুগ্ধগাঙে শিশু ডোবে আহ্লাদে আতুর!
শ্বেত হাসি, শ্বেত সুখ, শ্বেত যে বরণ
স্বরযন্ত্রে সুখপাখি মধুর মরণ!
চঞ্চল পাখিটির দাঁড়ে খাওয়া দোলা
কণ্ঠে ঢালে সুরধ্বনি, দেবীটি চপলা
আঙুলে আঙুল রাখে, পদপিষ্টে ফুল
থেকে সুধা ঝরে পড়ে সফেদ আকুল।
মাতৃক্রোড় হেসে ওঠে আনন্দে উতল
সুখে ভাসে ঘরবাড়ি, ভাসে জীবদল!
দুধগান শুনে তাই হাসে ধরণীও
নারীদেহ পুণ্যদেহ সকলে জানিয়ো—
এবে পুণ্যগীতা পাঠ করে মুনিবান।
মুনিকণ্ঠে শ্লোক সে যে অনঘসমান।।
৫
শরীরে বিষাদপাখি, মনে কোলাহল
ছেড়ে মাতা জেগে ওঠে পুণ্যের আঁচল;
কাঁধে ফেলে কষে বসে করে তোড়জোড়,
ফুটিফাটা মাটি মাঝে নব ভুঁইফোঁড়
অঙ্কুর উঠেছে যবে বিধাতার দানে—
জলমগ্ন হাওয়ামগ্ন সুধা ঢালে প্রাণে।
দু-বাহু বাড়িয়ে নারী করে কাড়াকাড়ি,
পিছে ফেলে অশ্রু আর দুঃখ-ঘরবাড়ি।
দুধের আলপনা আঁকে মুগ্ধ পূজার
হাতে-পায়ে-ঠোঁটে-গালে— সুখের উজাড়!
পিঠে যত্নে নেয় তুলে, কাঁখেও তুমুল;
নদী হয়ে নামে স্নেহ ভাসিয়ে দু-কূল
সেই জলে ভাসে সাধু, ভাসে মুনিবান।
স্রোতনদী সুধানদী অনঘসমান।।